চিকুনগুনিয়া কি, চিকুনগুনিয়া কেন হয় এবং প্রতিকারের উপায়
চিকুনগুনিয়া কি, চিকুনগুনিয়া কেন হয় এবং প্রতিকারের উপায়
আমরা নিচে “চিকুনগুনিয়া কি, চিকুনগুনিয়া কেন হয় এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়” বিষয়ের উপর বিস্তারিত বাংলা আর্টিকেল উপস্থাপন করা হলো। চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। এই রোগের প্রধান কারণ হলো সংক্রমিত মশা, বিশেষ করে এডিস এজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস।
সংক্রমণের পর জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ও র্যাশ দেখা যায়। স্থির পানিতে মশার বংশবিস্তার রোধ করাই প্রতিরোধের মূল উপায়। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা ও মশারি ব্যবহার করলে সংক্রমণ ঝুঁকি কমে। চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তাই বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত পানি পানই প্রধান প্রতিকার।
পোস্ট সূচিপত্রঃ চিকুনগুনি য়া কি, চিকুনগুনিয়া কেন হয় এবং প্রতিকারের উপায়
চিকুনগুনিয়া কী, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের উৎস
চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ও জটিলতা
চিকুনগুনিয়া কি, চিকুনগুনিয়া কেন হয় এবং প্রতিকারের উপায়
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই আর্টিকেলে জানুন, চিকুনগুনিয়ার কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ, ও ঘরোয়া প্রতিকারসহ চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম এলেই মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। বিশেষ করে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন সবচেয়ে সাধারণ ভাইরাসজনিত সংক্রমণ।
আরো পড়ুনঃ
অনেকেই এই দুটি রোগকে একই মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে এদের মধ্যে পার্থক্য অনেক। চিকুনগুনিয়া মূলত চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ, যা Aedes aegypti এবং Aedes albopictus নামের দুটি মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশাগুলো দিনে কামড়ায় এবং তাদের কামড়ের মাধ্যমেই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে।
চিকুনগুনিয়া কী, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের উৎস
চিকুনগুনিয়া (Chikungunya) শব্দটি এসেছে আফ্রিকার মাকোন্ডে ভাষা থেকে, যার অর্থ “যে হাঁটতে পারে না” বা “বাঁকা হয়ে হাঁটে”। কারণ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তীব্র জয়েন্ট পেইনের কারণে শরীর সোজা করে হাঁটতে পারেন না।
চিকুনগুনিয়া হলো এক ধরনের ভাইরাসজনিত জ্বর, যা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) দ্বারা হয়। এটি Togaviridae পরিবারের সদস্য এবং Alphavirus গোত্রের অন্তর্গত।
এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে রক্তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে জ্বর, জয়েন্ট পেইন, মাথাব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি, এবং দুর্বলতা দেখা দেয়।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৫২ সালে তানজানিয়ায়। পরবর্তীতে এটি আফ্রিকা, এশিয়া, এবং আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এটি একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ভাইরাসটি মূলত মানুষ-মশা-মানুষ চক্রে ছড়ায়। যখন কোনো মশা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন মশাটি ভাইরাস বহন করে এবং পরবর্তী সময়ে অন্য কাউকে কামড়ালে তার শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করে।
চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের কারণ
চিকুনগুনিয়া রোগের মূল কারণ হলো ভাইরাস সংক্রমণ। এটি ছড়ায়, এডিস মশার কামড়েঃ এই মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। সাধারণত সকালে ও বিকেলে কামড়ানোর প্রবণতা বেশি। দূষিত পরিবেশে মশার প্রজননঃ
বাসাবাড়ি, ফুলের টব, পুরনো টায়ার, পানির ট্যাংক, মগ বা ড্রামের মধ্যে পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা জন্মায়। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে সংক্রমণঃ মশা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ে আবার অন্যজনকে কামড়ালে ভাইরাস স্থানান্তরিত হয়।
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ ও জটিলতা
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ সাধারণত মশার কামড়ের ২ থেকে ৭ দিন পর প্রকাশ পায়। প্রধান লক্ষণগুলো হলো । প্রধান লক্ষণঃ উচ্চ জ্বর (১০২°-১০৪°F পর্যন্ত), অস্থি ও জয়েন্টে তীব্র ব্যথা, হাত-পা ফুলে যাওয়া, মাথাব্যথা ও চোখে ব্যথা, শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ, অতিরিক্ত ক্লান্তি ও অবসাদ। অন্যান্য উপসর্গঃ বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা, ঘুমের সমস্যা, পেশিতে টান, গলা ব্যথা।
চিকুনগুনিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
অনেক ক্ষেত্রে জয়েন্ট পেইন ৩–৬ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক বা আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর পার্থক্য
বিষঃ চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, রোগের কারণ, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস, ডেঙ্গু ভাইরাস, মশার প্রকার, এডিস এজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। একই মশা, জ্বরের ধরন, হঠাৎ উচ্চ জ্বর ও জয়েন্টে ব্যথা। উচ্চ জ্বর, চোখের পিছনে ব্যথা, রক্তক্ষরণ। জয়েন্টে ব্যথা, খুব তীব্র, তুলনামূলক কম, র্যাশ বা ফুসকুড়ি, বেশি দেখা যায়। তুলনামূলক কম, রক্তক্ষরণ, সাধারণত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে হয়।
চিকুনগুনিয়ার নির্ণয় পদ্ধতি
চিকুনগুনিয়া নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করতে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। নিচের পরীক্ষাগুলো সবচেয়ে প্রচলিত।RT-PCR (Reverse Transcriptase Polymerase Chain Reaction)ঃ ভাইরাসের জিন শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
IgM/IgG Antibody Testঃ সংক্রমণ হয়েছে কিনা বা আগে হয়েছে কিনা তা জানতে ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসকরা সাধারণত রোগীর উপসর্গ দেখে প্রাথমিকভাবে চিকুনগুনিয়া সন্দেহ করেন এবং প্রয়োজনে এই পরীক্ষাগুলো নির্দেশ দেন।
চিকুনগুনিয়ার সাধারণ চিকিৎসা
চিকুনগুনিয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা টিকা নেই। চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক বা supportive treatment।
প্যারাসিটামল (Paracetamol): জ্বর ও ব্যথা কমাতে ব্যবহৃত হয়। বেশি পরিমাণে পানি পান করুন: শরীরে পানিশূন্যতা রোধে দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: শরীরকে বিশ্রাম দিলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। হালকা খাবার খান: যেমন ভাত, স্যুপ, ফলমূল ইত্যাদি।
চিকুনগুনিয়ায় যা করা উচিত নয়
আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। নিজে থেকে ওষুধ গ্রহণ করবেন না, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।
চিকুনগুনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার ও সহায়ক পদ্ধতি
চিকুনগুনিয়ার ব্যথা ও ক্লান্তি দূর করতে কিছু ঘরোয়া উপায় অত্যন্ত কার্যকর ।
১. গরম পানির সেঁকঃ জয়েন্ট পেইন বা ফোলাভাব কমাতে দিনে ২-৩ বার গরম পানির সেঁক নিন।
২. লেবু পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট পানীয়ঃ জ্বরের কারণে শরীর থেকে লবণ-পানি বেরিয়ে যায়, তাই লেবু পানি ও ওরস্যালাইন খেলে শরীর হাইড্রেট থাকে।
৩. পুষ্টিকর খাবারঃ সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার (ডিম, মাছ, ডাল) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৪. আদা ও তুলসী চাঃ আদা ও তুলসীতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
৫. পর্যাপ্ত ঘুমঃ দৈনিক ৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরের পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায়
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের মূল উপায় হলো মশার জন্ম ও কামড় রোধ করা। নিচে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলোঃ
১. মশার প্রজনন বন্ধ করুনঃ জমে থাকা পানি ৩ দিনে একবার ফেলে দিন। ফুলের টব, টায়ার, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোসা ইত্যাদি শুকনো রাখুন।
২. মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচানঃ পুরো হাত-পা ঢাকা পোশাক পরুন। রাতে মশারি ব্যবহার করুন। রিপেলেন্ট বা লোশন ব্যবহার করুন।
৩. পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুনঃ বাড়ির আশপাশে ময়লা, আবর্জনা জমতে দেবেন না। ড্রেন ও নালা পরিষ্কার রাখুন।
৪. সামাজিক উদ্যোগঃ এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান। মশা নিধনে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করুন।
বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া প্রথম বড় আকারে ছড়ায়। তৎকালীন তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। ঢাকা শহরে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল।
এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সীমিত আকারে সংক্রমণ দেখা যায়। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS) নিয়মিতভাবে চিকুনগুনিয়াসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগের পর্যবেক্ষণ করছে।
চিকুনগুনিয়া থেকে সেরে ওঠার পর যত্ন
চিকুনগুনিয়া থেকে সুস্থ হতে সাধারণত ৭–১০ দিন সময় লাগে, তবে জয়েন্টের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এজন্য, হালকা ব্যায়াম করুন, যেমন স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম।
আরো পড়ুনঃ
ফিজিওথেরাপি নিন, যদি ব্যথা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, যাতে ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি না হয়। মানসিকভাবে ধৈর্য ধরুন, কারণ সুস্থ হতে কিছুটা সময় লাগে।
চিকুনগুনিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন ১: চিকুনগুনিয়া কি প্রাণঘাতী?
সাধারণত নয়। তবে বয়স্ক, গর্ভবতী মহিলা ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা হতে পারে।
প্রশ্ন ২: চিকুনগুনিয়ার টিকা কি আছে?
বর্তমানে কোনো অনুমোদিত টিকা নেই, তবে গবেষণা চলছে।
প্রশ্ন ৩: বারবার চিকুনগুনিয়া হতে পারে কি?
সাধারণত একবার আক্রান্ত হলে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, ফলে দ্বিতীয়বার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
লেখকের শেষ কথাঃ চিকুনগুনিয়া কি, চিকুনগুনিয়া কেন হয় এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
চিকুনগুনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য ভাইরাসজনিত রোগ। এটি মারাত্মক না হলেও প্রচণ্ড জয়েন্ট পেইন ও দুর্বলতা সৃষ্টি করে, যা দৈনন্দিন জীবনে ভোগান্তির কারণ হয়।ব্যক্তিগত সচেতনতা, পরিবেশ পরিষ্কার রাখা, এবং মশার কামড় এড়ানোই এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়।
তাই আসুন, সবাই মিলে মশামুক্ত পরিবেশ তৈরি করি এবং নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখি। “চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ সম্ভব, যদি আমরা সচেতন হই, মশার জন্মস্থান ধ্বংস করি, এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।”


অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url